‘গীতিকার তৈরির কারখানা হলো বাংলাদেশ বেতার’ : রফিকুল আলম
বেতারেই আমার জীবনে প্রথম মাইক্রোফোনের সম্মুখীন হওয়া। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়তাম। সেই ’৬০-এর দশকের কথা। রাজশাহী বেতারে তখন স্টুডেন্ট ফোরামের অনুষ্ঠান হতো। এ অনুষ্ঠানেই আমি প্রথম বেতারে গান গেয়েছি। কোনো অডিশন ছাড়াই আমি গান গাওয়ার সুযোগ পাই। সে সময় মঞ্চে আমি ভালো গান গাইতাম। সে সুবাদেই বেতারের ডাকে গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয় আমার।
‘যায় নিয়ে যায় আমায় নিয়ে যায়’ শিরোনামের এ রবীন্দ্রসঙ্গীতটিই ছিল আমার বেতারে প্রথম গাওয়া গান। তখন সবাই খুব রেডিও শুনত। গানটি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ সাড়া পেতে থাকি। ফলে রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে আমাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর আগ্রহ তৈরি হলো। সে সময় বেতারে নির্বাচিত হওয়া খুব কঠিন ছিল। অডিশন দিয়ে পাস করতে হতো। কিন্তু আমি ভালো গাওয়ার কারণে অডিশন ছাড়াই নির্বাচিত হই। শুরুর দিকে আমি শুধু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইতাম। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধ এল।

শিল্পী রফিকুল আলম।
আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিলাম। সে সময় পণ্ডিত হরিপদ দাস, আব্দুল জব্বার, সুজেয় শ্যাম, সমর দাশ মুগ্ধ হয়েছিলেন। আবার গান শুনে তারা বলেছিলেন, আমি ভালো করব। এরপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্রের মতো গুণী শিল্পীর সামনে গান গেয়েছি আমি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার ৬টি গান রেকর্ড হয়। এর মধ্যে ‘যায় যদি যাক প্রাণ তবু দেব না দেব না গোলার ধান’ শিরোনামে একটি সলো গান ছিল।
১৯৭৩ সালে প্রথম আমি আধুনিক গান গাই। ঢাকা বেতারে গাওয়া আমার প্রথম গান ছিল-‘তোমাকে যেন ভুলে না যায়’। এস এম হেদায়েতের কথায় গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন লাকী আখন্দ। গানটি গাওয়ার ঠিক পরের দিনই আমি সিনেমায় গান গাওয়ার অফার পেয়েছিলাম। সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা আমাকে গানটি গাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার প্রথম শিক্ষাগুরু অনুপ ভট্টাচার্যের সুরে আবুল হায়াত মোহাম্মদ কামালের লেখা গানটি ছিল ‘বৈশাখী মেঘের কাছে জল’।
এরপর প্রতি বছরই আমাকে সিনেমায় গাইতে হতো। রেডিওতে আমার গাওয়া ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’ গানটি সে সময় সিনেমায় আবার নতুন করে গাওয়ার পর ব্যবহার করা হয়। এরপর আব্দুল হাই আল হাদীর কথায় এবং আলাউদ্দিন আলীর সুরে ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’ গানটি গাওয়ার পর আমার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে বেতারের কারণে।
বেতারে আমরা লাইভ প্রোগ্রাম করতাম। ফলে ১৯৭৩ থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমি দাপটে গান করতে পারছি। আর বেতারে লাইভ গান গাওয়ার জন্য এটা সম্ভব হয়েছে। সব শিল্পীর জন্যই এ ক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে বেতার। তাই শিল্পীদের জীবনে বেতারের বিরাট অবদান। তখন ঘনঘনই বেতারে গাইতে হতো। মাসে মাসে ৩-৪ বার গানের জন্য ডাক পড়ত; প্রতিবারই ৪-৫টি করে গান গাইতে হতো। আসলে ওটা শুধু গান গাওয়াই ছিল না, প্র্যাকটিস ছিল। তাতে সব শিল্পী বিশেষত আমি কনফিডেন্স অর্জন করেছি।
১৯৭৮ সালের দিকে বাংলাদেশ বেতারের ক্ষমতা আরো বেড়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারে তখন বাংলাদেশ বেতার শুনতে পাওয়া যেত। সে সময় বাংলাদেশ বেতারের কমার্শিয়াল সার্ভিস খুবই জনপ্রিয় ছিল। আমি নিজেও বিহার অঞ্চলে আমার গান শুনেছি। এমনকি মঞ্চেও তারা বাংলা গান গাইত।
আর এসবই বেতারের অবদান। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে, আমার ক্ষেত্রে, কনফিডেন্ট শিল্পী তৈরির ব্যাপারে এখনো বেতারের ব্যাপক ভূমিকা। আমি এখনো বেতারে গান গাই। এখন রেকর্ডেড গানই গাই। বেতারের মাধ্যমেই শুধু শিল্পী নয়, সুরকার, গীতিকার, যন্ত্রশিল্পী তৈরি হয়েছে অনেক বেশি। গানের ক্ষেত্রে বেতারের এখনো ভূমিকা আছে। এখনো নতুন সুরকার-গীতিকার তৈরি করার কারখানা বেতার।
সূত্র: ভোরের কাগজ, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ।
https://www.bhorerkagoj.com/print-edition/2014/12/06/8127.php