বিশ্বায়ন ও সঙ্গীত আর অডিও মিডিয়া
অনেক দেশের হাজারো মানুষের বিচরণে এক বিচিত্র শহর লন্ডন। বিশ্বায়নের এক চমৎকার উদাহরণ। বিশ্বের সকল কর্পোরেট দপ্তরগুলোর অফিস রয়েছে এই শহরে। লন্ডনে প্রথম অবতরণ করি ২০১২ সালে। এক সপ্তাহের জন্য এসেছি। ভিক্টোরিয়া রেল স্টেশন থেকে বেড় হয়ে একটি টেক্সি ক্যাব দেখতেই ডাক দিলাম। এগিয়ে গেলাম আগ্রহী ড্রাইভারের দিকে । বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম,
: হ্যালো! তুমি কি আমাকে দয়া করে একটু সহায়তা করবে? দেখ আমি এই শহরে প্রথম এসেছি এবং কাছেই আমার এক আত্মীয় বাস করে? এরপর আমার হাতের কাগজে লেখা গন্তব্যের ঠিকানাটা ওকে পড়ে শোনালাম এবং জিজ্ঞেস করলাম দয়া করে আমাকে আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছে দিবে?
টেক্সি ড্রাইভার আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার অতি বিনয়ী ভঙ্গী কিনা জানি না, তবে ওকে বেশ কনফিউজ দেখা যাচ্ছে। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে ওর বিলম্ব দেখে আমিও অনেকটা কনফিউজড হয়ে গেলাম। টেক্সি ড্রাইভার কিছুটা সময় চিন্তা করে, আমাকে জিজ্ঞেস করল,
: তুমি কি যেতে চাও? নাকি যাবে না?
আমি অবাক! আমিতো যেতেই চাই!
যাই হোক, সে বার, লন্ডন ভ্রমনে শহরটির বিশালতা আর সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ের সীমা ছিল না। বিভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অজস্র মানুষের মাঝে অপূর্ব মিথস্ক্রিয়া বজায় রেখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে লন্ডন! বিশ্বায়নের উপাদান সমূহের কি চমৎকার সমন্বয়! প্রতি বছর হাজারো অভিবাসী লন্ডন শহরে বসবাসের জন্য আসেন এবং মজার ব্যাপার হলো এ সকল অভিবাসীদের মাঝে নিজস্ব সংস্কৃতির পরিবর্তে বহুজাতিক সংস্কৃতি অধিকতর দৃশ্যমান হয়ে উঠে। বোধ করি বিশ^ায়ন এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। আচ্ছা, বিশ^ায়নের একটি ব্যবহারিক সংজ্ঞা যদি দাঁড় করাতে চাই, সেটি কেমন হবে? গত কয়েক দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে, বেশ ভাবছি । এক সময় খুব জানতে ইচ্ছে করত, গানের প্রসারে বিশ^ায়ন কিভাবে ভূমিকা পালন করে? তখন স্কুলে পড়ি। সঙ্গীত শিল্পী সিলন ডিওনের বিখ্যাত গান মাই হার্ট উইল গো অন এন্ড অন, চারপাশে বেশ শুনতে পেতাম। আমাদের দেশ থেকে অনেক দূরের, কানাডার এক শিল্পীর পরিবেশিত গান আমরা মন দিয়ে শুনতাম আর বিমোহিত হতাম। ওপার বাংলার ভূপেন হাজারিকা কিংবা নচিকেতা এরাই বা কম কিসে! আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীত তখনো ভিত রচনার প্রত্যয়ে লিপ্ত। সেই সময়ে সোলস কিংবা ডিফারেন্ট টাচ ব্যান্ডের সুরের মূর্ছনায় আমরা ভীষণ আহ্লাদিত হতাম, ভাবতাম, বাহ! বেশতো!। স্কুল জীবনে মোহের এই পরিমান এতটাই বেশী ছিল যে, কখনো কখনো মনে হতো, শিল্পী হতে পারেলে, আহা! জীবনটা ধন্য হয়ে যেতো!
মনে পড়ে, চাকুরী জীবনের প্রথম দিনগুলোর কথা। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণকালে বিশ্বায়নের একটি সংজ্ঞা নিয়ে আমরা বেশ আলোচনা করতাম। ব্যাপারটি ছিল, এই রকম, “এক ইংরেজ রাজকন্যা তার মিশরীয় বন্ধুসহ ডাচ ইঞ্জিনে নির্মিত জার্মান গাড়ীতে ভ্রমন করতে গিয়ে ইটালীয় পাপারাজ্জি দ্বারা জাপানী মোটর সাইকেলে করে অনুসরণের শিকার হন । এ অবস্থায় স্কটিশ হুইস্কি পানে মদ্যপ বেলজিয়ান ড্রাইভার দ্রুত ড্রাইভিং করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে গাড়ীসহ ফ্রান্সের ভূগর্ভস্থ টানেলে বিধ্বস্ত হন। দুর্ঘটনায় আহতদের, আমেরিকান এক ডাক্তার ব্রাজিলিয়ান ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করেন যা কিনা আবার, কানাডিয়ান ব্যবসায়ী কর্তৃক বিল গেটস প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছিল। -যাই হোক, আপনি এই বার্তাটি এই মুহুর্তে পড়ছেন সম্ভবত আইবিএম নির্মিতে একটি ক্লোন প্রিন্টারের মুদ্রিত কাগজে, যেটি বাংলাদেশী শ্রমিকদের দ্বারা সিঙ্গাপুরে এসেম্বল করে ভারতীয় লরিচালক কর্তৃক বহন করতে গিয়ে, পথে ইন্দোনেশিয়ান স্মাগলার দ্বারা ছিনতাই হয়ে সিসিলীর সমূদ্রতীরে খালাস করে মেক্সিকান অবৈধ শ্রমিকদের দ্বারা বহন করে অবশেষে মার্কিন মুলুকে বিক্রয় করা হয়েছে”। -এই ভাবে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সহায়তায় সবশেষে এই বার্তাটি আপনি পড়ছেন!” বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বহুল পরিচিত এই সংজ্ঞার প্রতিটি কৌশলী সংযোজক-এর ন্যায় মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন প্রযুক্তির আর্বিভাব সঙ্গীতের বিশ্বায়নে প্রতি মুহুর্তে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে বলেই ধারণা বোধ করি। এরকমই একটি উদাহরণ স্পটিফাই।

স্পটিফাই লোগো
স্পটিফাই ডট কম এই শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই কম-বেশী পরিচিত। সঙ্গীত-এর প্রসার এবং বিশ্বায়নে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংস্থাটি দুনিয়াব্যাপী বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এবং আজো এই ধারা অব্যাহত রেখেছে। মূলত স্পটিফাই ২০০৮ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ ওশেনিয়া এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়াতে নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সারা বিশ্বে স্পটিফাই-এর ১০ কোটি মাসিক ব্যবহারকারী রয়েছে এবং ৪ কোটি পেইড সাবসক্রাইবার রয়েছে। জুন/২০১৬ -এর হিসেব অনুযায়ী স্পটিফাই সার্ভারে ৩ কোটি সঙ্গীত শ্রোতাদের স্ট্রিমিংয়ের জন্য সংরক্ষিত আছে এবং এই সংখ্যা প্রতি দিন বেড়ে চলেছে। নতুন ব্যবহারকারী সৃষ্টির জন্যে উইন্ডোজ, ম্যাক, লিনাক্স, আইওএস, এন্ডরয়েড সহ জনপ্রিয় সকল প্লাটফর্মের জন্যই স্পটিফাই-এর নিজস্ব এ্যাপস রয়েছে যা মোবাইল, ট্যাব এবং ডেস্কটপ-এ ব্যবহারের জন্য ষোল আনা উপযোগী। একজন ব্যবহারকারী স্পটিফাই সাইটে শিল্পী, এ্যালবাম, গানের জেনরা, প্লেলিস্ট এবং রেকর্ড লেভেল অনুযায়ী গান খুঁজতে পারেন। ব্যবহারকারী নিজস্ব প্লেলিস্ট তৈরি এবং সামাজিক মাধ্যমে তা শেয়ার করতে পারেন এবং অন্য ব্যবহারকারীদের নিয়ে সমন্বিত প্লেলিস্ট তৈরি করতে পারেন। মূলত মিউজিক, পডকাস্ট এবং ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা প্রদানকারী স্পটিফাই সঙ্গীত জগতে প্রযুক্তিগত বৈপ্লবিত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। দুটি মৌলিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে স্পটিফাই শিল্পী, প্রযোজকদের অর্থ প্রদান করে থাকে। প্রথমত শিল্পীর সঙ্গীত কতবার স্ট্রিমিং হয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, সত্বাধিকারীর সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত-এই দুই মিলিয়ে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এবং প্রযোজকরা স্পটিফাই থেকে তাদের সৃজনশীলতার সম্মানী পেয়ে থাকেন। একটি এ্যালবাম সরাসরি বিক্রি বা ডাউনলোড করে বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতিবার মূল্য নির্ধারিত থাকে। কিন্তু স্ট্রিমিং ব্যবসায়, সেবা প্রদানের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে স্পটিফাই শিল্পী সম্মানী প্রদানে মার্কেট শেয়ারকে বিবেচনা করে থাকেন। ফলে নির্দিষ্ট শিল্পীর জন্য সম্মানী মার্কেট শেয়ারের উপর ভিত্তি করে উঠা নামা করে। সুতরাং স্পটিফাই থেকে প্রাপ্ত সম্মানী পরিবর্তনশীল এবং কারো কারো মতে এটি নির্ভরযোগ্য নয়। স্পটিফাই ঝড়ের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর উপস্থিতিতে এককভাবে নির্দিষ্ট শিল্পীর গান ডাউন লোড করে সিডি বিক্রির প্রবনতা এখন নিম্নমুখী। ব্যবহারকারীর জন্য শুধুমাত্র একটি সিডির গান ডাউনলোড করে বা বাজার থেকে ক্রয় করে অর্থ প্রদান করার চাইতে বরং ৩ কোটি গানের মাঝ থেকে ইচ্ছে মত গান স্ট্রিমিং করে মাসিক অর্থ প্রদান অনেক বেশী লোভনীয়। ফলে, স্পটিফাইয়ের উপস্থিতিতে একজন নবাগত শিল্পীর জন্য সঙ্গীত ইন্ডাস্ট্রিতে নিজস্ব ভিত রচনা এবং অবস্থান ধরে রাখা, এখন পূর্বের যে কোনও সময়ের চাইতে অনেক প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে স্পটিফাই এর বক্তব্য হলো, স্পটিফাই প্রযুক্তির কারণে, “মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে পাইরেসির সুযোগ কমে এসেছে এবং অংশীজনরা এখন অনলাইন প্লাটফর্মে অধিক মাত্রায় সার্বক্ষনিক বিচরণ ও নগদ লাভের সুযোগ পাচ্ছেন”। মূলত, সক্ষমতার এই ইতিবাচক পরিবর্তনে শিল্পীদের রয়েলিটি প্রাপ্তির সুযোগ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী নিশ্চিত হয়েছে। স্পটিফাই প্রযুক্তিতে প্রথমে বিজ্ঞাপনযুক্ত ফ্রি সেবা প্রদান করা হলেও পরবর্তীতে ব্যবহারকারীদের পেইড সার্ভিসের প্রতি আকৃষ্ট করণের প্রয়াস রচনা করা হয়। এই ভাবে, স্পটিফাই সৃজনশীল মননের প্রসারে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।

বিটস-১ রেডিও স্টেশনের লোগো
স্পটিফাই প্রযুক্তির বিশালত্ব এবং সঙ্গীত জগতের বিপুল সম্ভাবনার বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে এ্যাপল কোম্পানী ২০১৫ সালে চালু করেন এ্যাপল মিউজিক অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস । এই সেবার আওতায় আরো রয়েছে ২৪ ঘন্টা ব্যাপী প্রচারমান ইন্টানেট রেডিও স্টেশন বিটস-১ এবং ব্লগ প্ল্যাটফর্ম কানেক্ট। ব্যবহারকারীগন এই কানেক্ট প্লাটফর্মে মাধ্যমে যুক্ত হতে পারেন পছন্দের শিল্পী এবং সৃজনশীলদের সাথে, প্রিয় শিল্পীকে করতে পারেন অনুসরণ। এই সেবার আওতায় এ্যাপল মিউজিক প্রত্যেক ব্যবহারকারীর নিজস্ব পছন্দ এবং ব্রাউজিং হেবিট বিবেচনা করে রিকমেন্ডেড গানের তালিকাও সরবরাহ করেন। বিশ্বব্যাপী ১০০র উপরে দেশে এই সেবা প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মজার বিষয় হলো, এ্যাপল মিউজিক অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস একটি পেইড সার্ভিস এবং ডিসেম্বর/১৬-এর হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী এই সার্ভিসের দুই কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে। যাই হোক, সংবাদটি পড়ে খুব অবাক হয়েছি। এ্যাপল কোম্পানী করবে গানের ব্যবসা? ওরা সফল হবে তো? এ্যাপল কোম্পানীর অতীতের অর্জণ দেখে এটি কখনও মনে হয় না “এরা ভূল করতে পারে!” নিজস্ব শ্রম, মেধা এবং অপূর্ব ধী শক্তির অশ্রুতপূর্ব সমন্বয় দিয়ে ওয়াল স্ট্রিটে বরাবরই নিজেদের অবস্থান শীর্ষে ধরে রেখেছে। প্রযুক্তির জগতে টিকে থাকার জন্য এ্যাপল-এর রয়েছে ঈর্ষনীয় অসাধারণ যোগ্যতা। বহুজাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সংগ্রামেও এ্যাপল কোম্পানীর নিপুনতা ও সুনাম সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
বিশ্বায়নের এই বিকশিত যুগে, শুধুমাত্র অডিও মিডিয়াকে ভিত্তি করে, স্পটিফাই এবং এ্যাপল কোম্পানীর ন্যায় কর্পোরেট জায়েন্টদের প্রযুক্তি এবং প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ সঙ্গীতের প্রসারে যে সমৃদ্ধ ভূমিকা পালন করছে, পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমও একই ভূমিকা পালনে কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই। এমনই উদাহারণ ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন সংক্ষেপে বিবিসি। বিবিসি পৃথিবীর অন্যতম সেরা পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠান। বিবিসির রেডিও ওয়ান বিশ্বজুড়ে সঙ্গীতের প্রসারে সর্বজনস্বীকৃত ভূমিকা পালন করে চলেছে। রেডিও ওয়ান এবং ওয়ান এক্সট্রা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়স গ্রুপের শ্রোতাদের জন্য আধুনিক ও কাটতি জনপ্রিয় গান এবং টপ চার্টে অবস্থানকারী এ্যালবামসমূহ রাউন্ড দ্যা ক্লক সম্প্রচার করে থাকেন। স্টেশন দুটির ফ্ল্যাগশীপ অনুষ্ঠানগুলোর অন্যতম ব্রেকফার্স্ট শো, নিউজবিটস, ইন্টারভিউ, এবং পপুলার মিউজিক। বিবিসি ওয়ান তাদের প্রচার সময়ের একটি নির্দিষ্ট অংশজুড়ে সঙ্গীত ভূবনে অস্তিত্ব বিকাশে সংগ্রামে লিপ্ত বিদগ্ধ নবীন শিল্পীদের কিহ্নরি গান প্রচার করে থাকে। বলা হয়ে থাকে, বিবিসি পৃথিবীর বৃহত্তম পাবলিক সার্ভিস প্রদানকারী সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান। স্পটিফাই এবং এ্যাপল কোম্পানীর সঙ্গীত নিয়ে সমসাময়িক কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে বিবিসি কি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন? প্রশ্নটি বোধ করি, আসার অন্যতম কারণ, বিবিসির গঠনতন্ত্র। বিবিসি কোনও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয় এবং বাণিজ্যিকভাবে টিকে থাকার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রতিষ্ঠানটির নেই। অন্যদিকে এ্যাপল পুরো মাত্রায় একটি পেশাদারী বাণিজ্যিক এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। কিছুদিন আগে, একটি ইন্টারভিউ অনুষ্ঠানে বিবিসি রেডিও ওয়ান-এর কন্ট্রোলার বেন কুপারকে এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল। খুব আগ্রহ ভরে, বেন-এর উত্তরটি শুনবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বেন, প্রশ্নকর্তাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, এ্যাপল মিউজিক কিংবা স্পটিফাইয়ের কার্যক্রমের দরুন কোনও ভাবেই বিবিসি রেডিও ওয়ানের কোনও ক্ষতি হবে না। বরং তিনি বিষয়টিকে রেডিওর জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার উন্মোচন বলে দাবী করেন। কুপার-এর মতে, এতে করে রেডিওতে যে সব পেশাদারী ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের জন্য নিজস্ব যোগ্যতা বিক্রির বিশ্বমানের নতুন প্ল্যটফর্ম তৈরি হল। নাছোর প্রশ্নকর্তা, সবশেষে জানতে চাইলেন, এ্যাপল মিউজিক-এর ফলে, রেডিও ওয়ান-এর শ্রোতার সংখ্যা কমবে কিনা? বেন কুপার-এর মতে, এ্যাপল মিউজিক সার্ভিসের প্রতি অব্যশ্যই নতুন শ্রোতারা আকৃষ্ট হবেন। কারণ, সমাজে এটি নতুন উদ্ভাবন। কিন্তু এর মানে এই নয় বিবিসি রেডিওর শ্রোতা শূন্য হয়ে যাবে। বিবিসি রেডিওর রয়েছে নিজস্ব কিছু বিশেষত্ব, যেটি এ্যাপল কোম্পানীর নেই। বিবিসি বিশ্ব জুড়ে সেরা মানের রেডিও অনুষ্ঠান তৈরি করে থাকে। এটি হতে পারে স্পিচ রেডিও (যেমন রেডিও ফোর), হতে পারে মিউজিক রেডিও (যেমন রেডিও ওয়ান)। বিবিসি রেডিওর রয়েছে পেশাগত উৎকর্ষতা এবং শ্রোতার নিকট সার্বক্ষনিক সংযোগ রাখার যোগ্যতা। এ্যাপল মিউজিক তাদের প্রচারণায় বলছেন বিটস-১ চলবে ২৪/৭, কিন্তু রেডিও ওয়ান এই কাজটি করেছে ১৯৯১ সালে। দ্বিতীয়ত, এ্যাপল মিউজিক একটি স্ট্রিমিং সার্ভিস, কিন্তু বিবিসি রেডিও শুনবার জন্য স্ট্রিমিং করবার প্রয়োজন নেই। সর্বোপরি, যে জিনিসটি বিবিসি রেডিও করতে পারে, আমি নিশ্চিত নই এ্যাপল সেটি করতে পারবে কিনা! বিবিসি বিশে^র শত শত অঞ্চলে স্ট্রিমিং সার্ভিস ছাড়াই সম্প্রচার করে থাকে। বিবিসি কখনও কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপন করে না এবং বিবিসি শুনবার জন্য কোনও নির্দিষ্ট স্মার্ট ফোনের প্রয়োজন নেই এবং বিবিসির সেবা শ্রোতার জন্য একেবারেই ফ্রি।

বেতার বাংলা, পৌষ-মাঘ ১৪২৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারনেট রেডিও প্রতিষ্ঠান আই হার্ট রেডিও-এর সিইও এবং বিশ্ববরেণ্য মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বব পিটম্যান মনে করেন, স্পটিফাই কিংবা এ্যাপল মিউজিক কোনও ভাবেই রেডিওর জন্য হুমকি নয়। তিনি বেন কুপারের মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। বব পিটম্যান বলেন, সাধারণ বেতার শ্রোতাদের প্রায় ৯০ শতাংশ স্ট্রিমিং সার্ভিস বিহীন স্মার্টফোনে রেডিও শুনে থাকে এবং অবশিষ্ট ১০ শতাংশ শ্রোতা ডিজিটাল ভার্সনে রেডিও শুনে থাকে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ শতাংশ শ্রোতা নতুন মিউজিক এ্যালবাম সম্পর্কে জানতে পারেন এফ এম রেডিওর মাধ্যমে। তিনি বেতার যন্ত্রের বৈশিষ্টের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং প্রশ্ন করেন, বেতার যন্ত্রটি যদি ১৯২০-এর দশকে আবিষ্কৃত না হয়ে ২০১৭ সালে আবিষ্কৃত হতো, তাহলে যন্ত্রটির ধরণ কেমন হত? প্রশ্নটির উত্তর নিজেই দিতে গিয়ে পিটম্যান বলেন, অবশ্যই আজকের দিনে রেডিও আবিষ্কৃত হলে এতে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও অনেক বেশী হতো। তিনি বলেন, “চিন্তা করুন, রেডিও এমন একটি ডিজিটাল ডিভাইস যেখানে কোনও ডাটা চার্জ দেয়ার প্রয়োজন নেই এবং শুনবার জন্য কোনও বাফারিং এবং স্ট্রিমিং করবার প্রয়োজন নেই, ভেবে দেখুন, কি অসাধারণ একটি ফ্রিকোয়েন্সি হতো রেডিও”। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মজার বিষয় হচ্ছে, এ্যাপল মিউজিক কিংবা স্পটিফাই আমাদের প্রাযুক্তিক এই সুবিধাগুলি এখনও দিতে পারছে না”। এ প্রসঙ্গে, বিবিসি’র প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল জন রিথ-এর একটি বক্তব্য প্রনিধান যোগ্য। রিথ, ১৯২৪ সালে বলেছিলেন, “বেতার মাধ্যম প্রচলিত ডিমান্ড-সাপ্লাই নীতির আদলে কাজ করে না। এই মাধ্যমে একজনের অতিরিক্ত গ্রহণ কখনই অপর ভোক্তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে না।” তিনি আরও বলেন, “এক জন হোক, দশজন হোক কিংবা অজস্র জন হোক, শ্রবণের ক্ষেত্রে সম্প্রচার জগতে, শ্রোতার সংখ্যা কখনই বিবেচ্য বিষয় নয়”। বরং তিনি দাবী করেন, “বেতার যন্ত্র সবার জন্য এবং সকলের জন্যই পর্যাপ্ত”। যাই হোক, আমেরিকান পরিসংখ্যান বিবেচনা করে, দেশীয় প্রেক্ষাপটে, বাংলা সঙ্গীতের আর্ন্তজাতিক প্রসার এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত বিনির্মানে এ দেশের বেতার গণমাধ্যমের করনীয় সম্পর্কে আলোচনার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে। সময়োপযোগী নীতিমালা এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে এ দেশের এফ এম রেডিও স্টেশনগুলো এবং দেশব্যাপী বেতার মাধ্যম এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলেই ধারণা বোধ করি। আমেরিকাতে যদি আজো এফ এম রেডিও জনপ্রিয় হতে পারে, তাহলে আমাদের দেশে এমন পরিবেশ তৈরিতে এবং প্রয়োজনীয় প্রনোদনা সৃষ্টিতে দোষ কোথায়?
সঙ্গীতের চিরন্তন একটি বিষয় হচ্ছে এর সুর এবং এটি অডিও। বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে সঙ্গীতের সুরের বিস্তৃতি এখন অনেক ব্যাপকতর এবং সহজতর হয়েছে। সঙ্গীত বিশ্বায়নের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন ভাবে আলোচনা করে থাকেন। বিশ্বায়নের একটি সরাসরি প্রভাব হচ্ছে এর সুরের মোহনীয়তা। ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক পপুলার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির যে কোনও গুনগত পরিবর্তন ট্রেডিশনাল লোকাল মিউজিক-কে প্রভাবিত করে। বর্তমান সময়ে ভোক্তা চাইলেই সঙ্গীতের এ্যালবাম দোকান থেকে কিনতে পারেন, ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করতে পারেন অথবা নিজের স্মার্ট ফোনের সহায়তায় সহজেই এ্যাপস স্টোর থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। সঙ্গীতের এই সহজ লভ্য বিস্তরণের কারণে, সঙ্গীত গবেষকগণ ধারণা পোষণ করেন, সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে বৈশ্বিক পপুলার মিউজিকের সুর ও উপস্থাপন ঢংয়ের থাবা ক্রমশ লোকাল মিউজিকের ব্যাপ্তিকে হ্রাস করে তুলছে। এই প্রবণতার ক্রম বিকাশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে লোকাল সঙ্গীতের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক। এই বিষয়গুলো নিয়ে বাল্টিজ (২০০৫) “Globalization and Musical Culture” বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন, স্থানীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত ধারণাগুলোকে বলবান রাখতে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন যুগল উপস্থাপন কৌশল। স্পটিফাই কিংবা বিটস-১-এর বিশ্বায়িত উপস্থাপনকে সামলে নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশের ধারাকে অব্যহত রাখার জন্য প্রয়োজন নিজস্ব কৌশলগত এবং সক্ষমতা সম্পন্ন সঙ্গীত প্রনোদনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। স্পটিফাই কিংবা বিটস-১ কে বন্ধ কারার সুযোগ আমাদের নেই, তবে দেশীয় সঙ্গীতের জন্য প্রনোদনা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই আমাদের রয়েছে। এতে করে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের সুযোগও বাড়বে ।
এই প্রসঙ্গে, সঙ্গীতের চর্চার একটি সুফল দিক নিয়ে একটু আলোচনা করি। সঙ্গীত চর্চা এবং সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ মানুষের মেধার বিকাশে অত্যন্ত সহায়ক। বিজ্ঞানী ক্রিস্টা এল হাইড, জ্যাসন লার্চ এবং অন্যান্যরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ছোট বেলা থেকে সঙ্গীত চর্চা বিশেষ করে তার যুক্ত বাদ্যযন্ত্রের অনুশীলন ব্যক্তির ব্রেইনের বিকাশে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন অত্যন্ত সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন। বিখ্যাত এই বিজ্ঞানী ১৮ এপ্রিল ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এ সময়ে ডা: থমাস হার্ভি তার মৃতদেহের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট প্রনয়ন করেন । কিন্তু ড: হার্ভি কোন পূর্ব অনুমতি ছাড়াই আইনস্টাইনের ব্রেইন তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেন এবং সংরক্ষণ করেন গবেষণার জন্য । আইনস্টাইন ছোট বেলা থেকেই বেহালার চর্চা করতেন। প্রচলিত আছে যে, যখনই আইনস্টাইন পদার্থ বিজ্ঞানের কোনও জটিল সূত্রের বিশ্লেষনে ক্লান্ত হয়ে যেতেন, তখনই তিনি তার প্রিয় বেহালা নিয়ে বসতেন রিলাক্স বোধ করার জন্য এবং ঘন্টার পর ঘন্টা বাদন করতেন। এ প্রসঙ্গে আইনস্টাইন বলেন, “থিওরি অব রিলেটিভিটি আমি আবিষ্কার করি, মূলত আমার নিজস্ব অনুমানের (Intuition) উপর ভিত্তি করে এবং মিউজিক আমার এই অনুমান রচনার পিছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে”। সুতরাং, ব্যক্তির মেধার বিকাশেও সঙ্গীত একটি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। আলবার্ট আইনস্টাইনের ব্রেইন আজো ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার এ্যাট প্রিন্সটন, নিউজার্সিতে সংরক্ষিত আছে এবং আজো এই ব্রেন নিয়ে চলছে অজস্র গবেষণা।
বর্তমান বিশ্বে ফেসবুক, টুইটারের পর ইউটিউব অন্যতম বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্ম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সঙ্গীতের প্রসারে সোস্যাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। শিল্পী কনা’র রেশমী চুরি গানটি ইউটিউবে আজকের তারিখে প্রায় ৯২ লাখ ৫৫ হাজার দর্শক অবলোকন করেছে। একইভাবে আরও অনেক সঙ্গীত শিল্পী নিজস্ব এ্যালবামের গানটি আরও শ্রোতাপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ইউটিউবে আপলোড করে থাকেন। বোধ করি দৃশ্যমান দ্রুত ফলাফল প্রাপ্তি থেকেই তারা এমনটি করে থাকেন। যদিও আমাদের দেশে সঙ্গীতের প্রসারে শিল্পীর প্রনোদনা সৃষ্টির জন্য স্পটিফাই কিংবা রেডিও ওয়ান-এর মতো কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত এখনও গড়ে উঠেনি। গত এক দশকে আমাদের দেশের সঙ্গীত জগতের যে গুনগত বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তাতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এবং শিল্পীদের মণণ-এর বিকাশে এদেশে সঙ্গীত শিল্পকে আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য সঙ্গীতের বিশ্বায়নে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত রচনা করা। বাংলা গান, বাংলা সুর পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। সারা বিশ্ব জুড়ে যে অসংখ্য বাঙ্গালী ছড়িয়ে আছে, তাদের মাঝে জনপ্রিয়, মানসম্মত, এবং সর্বশেষ বাংলা মিউজিক ট্র্যাকের মূর্ছণা ছড়িয়ে দেবার জন্য আজ সময়ের দাবী প্রাতিষ্ঠানিক অনলাইন সম্প্রচার। সরকারী সংস্থার পক্ষে এটি সম্ভব হলে সোনায় সোহাগা, তবে বিকল্পভাবে হলেও তা সাদরে গ্রহণযোগ্য।
মিডিয়া গবেষক চিগন্যাল ২০০৯ সালে এক আলোচনায় বলেন, পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং-এ নিয়োজিত সংস্থার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট মাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের উপযোগিতা রাখে। ইন্টারনেট এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে সকল সামাজিক শ্রেণি নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম। ইন্টারনেট প্রযুক্তির স্পর্শে সমাজের সংখ্যা লঘুর কন্ঠস্বর কোনও অস্পষ্ট ওয়েব সাইটে আটকে থাকে না বরং এটি এমন পরশ পাথর যার পরশে অস্পৃশ্যের কন্ঠস্বর জন সম্মুখে উথ্থাপিত হয় । চিগন্যাল আরও বলেন, “ উন্নয়নশীল বিশে^ প্রায়শ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং-এর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এটি জনস্বার্থে সম্প্রচারে নিয়োজিত সংস্থার জন্য বিশাল সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টিতেও সমান পারদর্শী।” উদাহরণ হিসেবে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের বহুল প্রশংসিত বিবিসি ডট কম ওয়েবসাইট এর প্রসঙ্গ তুলে ধরা যায়। পূর্বে বিবিসির কার্যক্রম মূলত প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা বিবিসি রেডিও এবং বিবিসি টেলিভিশন। কিন্তু এখন এই কার্যক্রমে তৃতীয় প্রধান স্তম্ভ হলো বিবিসি অনলাইন, যেটি গড়ে উঠেছে বিবিসি ডট কমকে ভিত্তি করে। বিবিসির মূল্যবোধসমূহকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে রেডিও এবং টেলিভিশন মিডিয়ার সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে বিবিসি অনলাইন। সারা দুনিয়াব্যাপী নিজস্ব শ্রোতা ও দর্শক আকৃষ্টকরণে বিবিসি রেডিও এবং বিবিসি টেলিভিশনের প্রসারে বিবিসি অনলাইন নতুন সুযোগের সৃষ্টি করেছে এবং বহুল প্রশংসিত গণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

বিবিসি রেডিও ওয়ান-এর লোগো
রেডিও, টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার উপকরণ সমূহের এক অসাধারণ যুগপৎ উপস্থাপন বিবিসি অনলাইন। মিডিয়া গবেষকগণ এই ত্রিমাতৃক মিথ-উপস্থাপন কৌশলকে তাদের ভাষায় মিডিয়া কনভার্জেন্স নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। মূলত বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে বেতার যন্ত্রের যখন আবিষ্কার তখন থেকে মিডিয়া হিসেবে প্রিন্ট মিডিয়ার আদল থেকে বেড় হয়ে স্বতন্ত্র যাত্রা শুরু করে বেতার মাধ্যম। এরপর যোগ হয় টেলিভিশন। প্রিন্টসহ প্রতিটি মিডিয়া নিজস্ব স্বাতন্ত্র অবস্থান নিয়ে সমাজ বিনির্মানে সমাজিক দর্পণ হিসেবে কাজ করতে থাকে। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে কম্পিউটার প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী প্রসার প্রতিটি স্বতন্ত্র মিডিয়াকে কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে ক্রমশ একীভূত করে তোলে। মূলত কন্টেন্ট, কম্পিউটার এবং কম্যুনিকেশন-এই তিনের ধারাবাহিক সুষম একীভূতকরণের সামষ্টিক ফলাফল হচ্ছে মিডিয়া কনভার্জেন্স। আজকের দিনে একজন সঙ্গীত শিল্পী শুধু অডিও এ্যালবাম রিলিজ করেই খ্যাতি প্রত্যাশা করেন না, বরং নিজের প্রচারের জন্য এই সাথে ভিডিও এ্যালবাম এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন এবং সবশেষে ইউটিউবে আপলোড সহ ফেসবুক/টুইটার-এ ভাইরাল সৃষ্টির জন্য নানা কসরত করে থাকেন। সুতরাং অনলাইন এবং নিউ মিডিয়ার ক্রমশ বিকাশে একক মিডিয়া সুপ্রিমেসি ধীরে ধীরে কমে আসছে। আবার একই সাথে এটিও সত্য প্রতিটি মিডিয়া তার নিজস্ব গুরুত্ব আরও বিকশিত পরিসরে প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন নিউমিডিয়ার আর্শিবাদে। উদাহরণ স্বরূপ, বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র অডিও মিডিয়ার সহায়তায় স্পটিফাই কিংবা বিটস-১ এর মাধ্যমে একজন শিল্পী যতটা সহজে বিশ্বব্যাপী নিজের গান ছড়িয়ে দিতে পারছেন, এমনটি পূর্বে কখনও দেখা যায়নি । এটি বিশ্বায়নের অসাধারণ অর্জণ।
একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় তথ্যের যুগ (information age)। মূলত শিল্প বিপ্লবকে ছাপিয়ে তথ্য যুগের প্রবেশ। শিল্প যুগে যার যত বেশী ক্যাপিটাল সে তত বেশী সফল বা সম্পন্ন ছিল। এখানে ক্যাপিটাল বলতে মূলধন, জমি, সম্পদ, মেশিন-টুলস এগুলোকে ইঙ্গিত বহন করে। অন্যদিকে শিল্প যুগের চাইতে তথ্য যুগে তুলনামূলক সুবিধা লুকায়িত আছে সঠিক তথ্য সঠিক স্থানে সঠিক মাত্রায় ব্যবহারের যোগ্যতার উপর। আরো সহজ কথায়, বর্তমান শতাব্দীতে, গবেষণা লব্ধ সঠিক তথ্যের সুষ্ঠু ব্যবহারের সক্ষমতা যার যত বেশী রয়েছে সেই তুলনামূলক সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করেন এবং অন্যজনদের উপর প্রভাব বিস্তারের যোগ্যতা ধারণ করেন। এই বিষয়ে গবেষক কুং (২০০৮) বলেন, তথ্য যুগকে ছাপিয়ে আগামী শতাব্দী হবে জ্ঞান যুগ (knowledge age), যেখানে তুলনামূলক সুবিধা লুকায়িত থাকবে ব্যক্তির যোগ্যতার উপর, নিজস্ব জ্ঞানগত উৎকর্ষতার উপর। সমষ্টিগত বিবেচনায়, মানব সম্পদের যথার্থ পদায়ন এবং যোগ্যতর বিন্যাসের যোগ্যতার উপর নিহিত থাকবে আগামী শতাব্দীর প্রাতিষ্ঠানিক হেজিমনি।
যাই হোক, সঙ্গীতের বিস্তার আর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত রচনা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। এবার আমার প্রিয় চায়ের কাপে ফিরে আসি। আমি বর্তমানকে বড় ভালবাসি। পড়ন্ত এই বর্ষার বিকেলে, নিজ বারান্দার আরাম কেদারায় বসে এক কাপ চা হাতে, একটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবছি বার বার । বাংলাদেশের সঙ্গীতের বিকাশ আর বিশ্বায়নে, সঙ্গীতের সঠিক তথ্য সঠিক স্থানে সঠিক মাত্রায় ব্যবহারের যোগ্যতা নিয়ে আমারা কি প্রস্তুত? ভাবছি, আগামীবার লন্ডন গেলে, টেক্সি ড্রাইভারকে গন্তব্যের ঠিকানা কিভাবে জিজ্ঞেস করব? এবারও কি সে বলবে, “তুমি কি যাবে? নাকি যাবে না?”
*লেখক দেওয়ান মোহাম্মদ আহসান হাবীব, বাংলাদেশ বেতার সদর দপ্তরে উপপরিচালক (ট্রাফিক) পদে কর্মরত।
তথ্য সূত্র:
1.Kotzias, Nikos. “Theories on Globalization and Asymmetries of Reality”, Kastaniotis Editions S.A., Athens, Greece, Year: 2000, PP:14-27.
- Baltzis, Alexandros G. “Globalization and Musical Culture.”, Acta Musicological, vol. 77, fasc.1, Year: 2005, PP: 137-150.
- Aoyama, Yuko. “The role of consumption and globalization in a cultural industry: The case of flamenco”, Geoforum, vol. 38, Issue 1(January 2007), PP:103-113.
- Meyer, Gust De. “Cultural Globalization and Local Identity: The Case of Belgian Popular Music.” Popular Music and Society, 20:1, Year:1996, PP:123-134.
- Seago, Alex. “Where Hamburgers Sizzle on an Open Grill Night and Day”(?): Global Pop Music and Americanization in the Year 2000, American Studies, Vol. 41, No.2/3 (Summer/Fall 2000), PP: 119-136.
- Posner, Michael. In Writing Analytically with readings, “Image world.” ed. Evelyn Veitch, Thomson Learning, Canada, Year: 2006, PP: 98-104.