কামাল লোহানী: নেপথ্যের একজন কারিগর
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হলো আরেকটি নাম- কামাল লোহানী। সমাপ্ত হলো একটি বহুমুখী অধ্যায়ের। যে মানুষটি দেশের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ সম্প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন, সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে দেশকে গড়েছেন- তাঁকে প্রাপ্য সম্মান জানানোর সুযোগ না দিয়েই করোনাকালে তিনি চলে গেলেন। শিল্পী, সাংবাদিক, শব্দ সৈনিক- নানা উপমার ভিড়েও এককথায় কামাল লোহানী নেপথ্যের কারিগর। সারা জীবন নেপথ্যের কারিগর এ মানুষের মহাপ্রয়াণে তাঁকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি ও তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

যৌবনে রাজপথে শ্লোগানে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন কামাল লোহানী। মিছিলে, মিটিংয়ে কন্ঠকে কাজে লাগালেও কখনও পাকিস্তান বেতারে পা বাড়াননি তীব্র ক্ষোভে, প্রতিবাদে। সেই মানুষটিই দেশের প্রয়োজনে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের হাল ধরেছেন। দীর্ঘদিন সংবাদপত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তিনি সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মত পরিস্থিতিতে শ্রোতা তথা আপামর জনসাধারণের চাহিদা সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল। সে চাহিদা পূরণে যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কাঙ্খিত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের কাজে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। তারই মতো শব্দসৈনিকদের নিরলস প্রয়াসে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশার প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলে আশফাকুর রহমান খানসহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সহকর্মীদের সাথে নিয়ে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ কামাল লোহানী মুক্ত স্বদেশে ফিরে আসেন। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ তাঁকে বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হলো। সদ্য স্বাধীন দেশে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে শুরু করে চারটি স্পট থেকে সরাসরি ধারাবর্ণনার যে রিপোর্টিং আমরা শুনেছি, তা পরবর্তীতে বহুবছর বেতার সম্প্রচারে অনুপস্থিত ছিল । ১৯৭৩ সালে শাহবাগ বেতার ভবন চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল লোকসংগীত উৎসব। এ উৎসবের মধ্য দিয়েই অনেক শিল্পী বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে পা রাখেন। শহীদুল ইসলামসহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে তিনিও সেসময় সক্রিয় ছিলেন। পর্দার অন্তরালে ছিলেন বলেই হয়তো আজ আর কেউ তা মনে রাখে না। ১৩ মাস সময় বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্র ও ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে কাজ করার পর অম্লমধুর অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি আবার ফিরে গেলেন তাঁর প্রিয় লেখালেখির জায়গা- সংবাদপত্রে। পরবর্তীতে উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, শিল্পকলা একাডেমি, পিআইবি- বহু সংগঠনের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে কামাল লোহানীর ভূমিকা ছিল। তাঁর সাথে যারা কাজ করেছেন, তারা সেদিকটা তুলে ধরবেন প্রত্যাশায় সেবিষয়ে আর লিখলাম না।
কামাল লোহানীর পর বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রের হাল ধরেছিলেন শামসুল হুদা চৌধুরী। শব্দসৈনিক শামসুল হুদা চৌধুরীর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ বইটিতে কামাল লোহানী সহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকদের কর্মকাণ্ড বিস্তারিত জেনে আমার মনে প্রথম সম্প্রচারকর্মী হওয়ার স্বপ্ন জেগেছিল। সেখানে শিল্পীদের কথা ছিল, কলাকুশলীদের কথা ছিল। তবে আজ থেকে ২৫ বছর আগে আমি বাংলাদেশ বেতারে যোগ দেয়ার সময় শিল্পী হওয়ার চেয়েও অনেক বেশী নেপথ্যের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কেননা কামাল লোহানীর মতো নেপথ্যের থিঙ্ক-ট্যাঙ্করা কথা বলেন যত, কাজ করেন তাঁর চেয়েও বেশী। তাঁরা মানুষের মধ্যে খুবই সংগোপনে দেশপ্রেমের বীজ বপন করতে পারেন। স্বপ্নটা কেমন করে জানি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
২০১৪ সাল। বাংলাদেশ বেতারের ৭৫ বছর পূর্তিতে আমরা বিশিষ্টজনদের নিয়ে সম্মেলন করলাম বর্তমান সময়ের চালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকার জন্য পরামর্শ নিতে। কামাল লোহানীও সে সম্মেলনে ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রসঙ্গ তুলে তিনি এ প্রজন্মের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার দায়িত্বে নিয়োজিত বিসিএস (তথ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করেছিলেন। উন্নয়ন সম্প্রচারের সাথে একনিষ্ঠ বাংলাদেশ বেতারের কর্মকর্তাদের যেন চাকরির নিয়মিত পদোন্নতির জন্য, শিল্পীদের যেন রুটিরুজির জন্য ভাবতে না হয়, সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণের উপর তিনি জোর দিয়েছিলেন। সেসময়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় বেতার শুনেন জানিয়ে, বাংলাদেশ বেতারে পদায়িত তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য চার দফা ঘোষণা দিলেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ বেতারে কর্মরত বিসিএস কর্মকর্তাদের সমানুপাতিক হারে পদোন্নতির ঘোষণা এলে আরেকবার নেপথ্যের কারিগর কামাল লোহানীর বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রমাণ পেলাম আমরা।
কামাল লোহানীর সাথে বাংলাদেশ বেতার নিয়ে একান্তে আবারও কথা বলার সুযোগ হয় ২০১৭-তে। ঢাকা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমরা সম্মাননা জানিয়েছিলাম এ কেন্দ্রের প্রথম তিনজন আঞ্চলিক পরিচালক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক কামাল লোহানী, শামসুল হুদা চৌধুরী ও আশফাকুর রহমান খানকে। মরহুম শামসুল হুদা চৌধুরীর পক্ষে এসেছিলেন তারই পুত্র। আমরা বাংলাদেশ বেতারের কর্মকর্তারা অতীতকে ভুলে যাইনি দেখে কামাল লোহানী যে খুশী হয়েছিলেন, তার বহিঃপ্রকাশ ছিল তাঁর কথায় বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন। কর্মকর্তাদের ভাবনার ক্ষেত্রের বিস্তৃতির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃতির পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। আজ আম্পানের সময় আবহাওয়া পূর্বাভাসের পাশাপাশি যখন শুনি বেতারে ফোন-ইনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের কন্ঠও প্রচার হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে নবপ্রজন্মের কর্মকর্তাগণ শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর জন্য ভাবনার বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। যখন দেখি বাংলাদেশ বেতার এখন অনলাইন, ওয়েবসাইট, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউবসহ সকল যোগাযোগ মাধ্যমে সমান তালে সরকারের কাজগুলো জনসাধারণের কাছে পৌছে দিচ্ছে, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে বিসিএস তথ্য সার্ভিসের কর্মকর্তারা আজও ততটাই পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করছে।
যখন দেখি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে আমারই সহকর্মী করোনা উপেক্ষা করে কাজ করছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান শুনে নিজেকে উজ্জীবিত করছে আর সুস্থ হয়ে দিন গুনছে নিজের প্লাজমা দিয়ে আরেকজনের জীবন বাঁচানোর জন্য, তখন কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃতি চোখের সামনে ধরা দেয়। আমাদের শব্দসৈনিক কামাল লোহানী এভাবেই নেপথ্যে থেকে আমাদের কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগায়, কামাল লোহানীদের মৃত্যু নেই, তারা বেঁচে থাকে তাদের কর্মে।
লেখক : উপ-সচিব, সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার।
তথ্য সূত্র: কালের কন্ঠ, সোমবার । ৮ আষাঢ় ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। ২২ জুন ২০২০ খ্রিস্টাব্দ