আজ আন্তর্জাতিক নার্স দিবস
আজ ১২ই মে। মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে দায়িত্ব পালনকারী সকল সেবিকাদের স্বীকৃতির দিন। আজ আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। আধুনিক নার্সিংয়ের প্রবর্তক মহীয়সী সেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের সেবা কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্বব্যাপী তার জন্মদিন ১২ই মে আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশ নার্স এসোসিয়েশন ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই দিবসটি পালন করে আসছে।

১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মে ‘লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্প’ খ্যাত ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে এক সম্ভান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলকে আধুনিক নার্সিংয়ের প্রবর্তক বলা হয়। ১৬০০ হতে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে নার্সিং পেশার অন্ধকার যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ সময় দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল সাধারণের চিকিৎসা গ্রহণের একমাত্র মাধ্যম। হাসপাতালের কর্মচারীরা প্রায় সবাই ছিল অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন। সচ্ছল লোকেরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতেন না। ডাক্তারকে বাড়ি এনে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতেন। সেবিকা পেশায় নিয়োজিতদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। অনেকে এ পেশাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল সেবিকা পেশার জগতে এক অবিস্মরণীয় আলোকবর্তিকা। তার প্রয়াসে সেবিকা পেশা বিশ্বব্যাপী সম্মানজনক পেশায় অধিষ্ঠিত হয়।
মূলত, ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের হাতে আধুনিক নার্সিং পেশার জন্ম। ফ্লোরেন্স বিশ্বাস করতেন স্রষ্টা তাকে সেবিকা হওয়ার জন্যই পাঠিয়েছেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তিনি এই উপলব্ধি করেন। বাবা-মা প্রথমে ফ্লোরেন্সের সিন্ধান্ত মেনে নিতে চাননি। অবশেষে হাল না ছাড়া মেয়েটির সিন্ধান্তকেই গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি, ব্রিটেন ও ফ্রান্স এর সাথে রাশিয়ার ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে আটত্রিশ জন সেবিকাসহ ফ্লোরেন্স যুদ্ধের ময়দানে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ইংরেজ-তুর্কি নির্বিশেষে দু’দেশের আহত মুমূর্ষু সৈন্যদের দিনরাত ধরে প্রাণ ঢেলে সেবা করেন। গভীর রাতে হাসপাতালের করিডোরে রোগীদের প্রয়োজন দেখতে হাতে মোমবাতি নিয়ে তিনি হেঁটে বেড়াতেন। ফ্লোরেন্স ও তার সেবিকারা দুই বছর ধরে চলা ক্রিমিয়া যুদ্ধে আহতদের ক্লান্তিহীন সেবা দিয়ে গেছেন। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ফ্লোরেন্স সেবিকা প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। চার বছরে সংগ্রহ করেন পঁয়তাল্লিশ হাজার পাউন্ড। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নেও তার বিশেষ অবদান রয়েছে।
নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন, ’নাইটিংগেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ’ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল স্কুল অব নার্সিং’। ডা. এলিজাবেথ ক্লাডিওয়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কে চালু করেন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ। ফেøারেন্সকে অসংখ্য পদক ও উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছে। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রানী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেড ক্রস’ পদক প্রদান করেন। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে লাভ করেন, ‘অর্ডার অব মেরিট’। এছাড়াও ভূষিত করা হয় লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহত সৈন্যদের সেবার মাধ্যমে নার্সিংকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ায় তাকে ডাকা হতো ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই আগস্ট ১৩ই আগস্ট ৯০ বছর বয়সে এই মহিয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন।
মানবদরদী মহিয়সী নারী ফ্লোরেন্সের নামে চারটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় ইস্তাম্বুলে। লন্ডনে ওয়াটারলু ও ডার্বিতে রাখা রয়েছে তার প্রতিকৃতি। লন্ডনের সেন্ট থেমাস হাসপাতালে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের নামে একটি মিউজিয়ামও রয়েছে। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সাউন্ড আর্কাইভে তার কন্ঠস্বর সংরক্ষণ করা আছে। সেখানে ফ্লোরেন্স বলেছেন, ’যখন আমি থাকব না, সেই সময় আমার এই কন্ঠস্বর আমার মহান কীর্তিগুলোকে মানুষের কাছে মনে করিয়ে দিবে এবং এসব কাজের জন্য উৎসাহ জোগাবে’।