নজরুল সঙ্গীত বিষয়ক প্রাসঙ্গিক তথ্য
আজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্ম বার্ষিকী। তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির মধ্যে নজরুল সঙ্গীত হচ্ছে তাঁর প্রতিভার উৎকর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। নজরুল সঙ্গীত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও সুরারোপিত গান। তিন হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন তিনি । নজরুল সঙ্গীত বাংলা গানের অণুবিশ্ব; এতে বাংলা সঙ্গীতের সমস্ত ধারার মিলন ঘটেছে।

কাজী নজরুল ইসলামের কবি, সঙ্গীতজ্ঞ ও শিল্পী জীবনের সূত্রপাত লেটোদল থেকে। এখানেই তাঁর কবিতা, গান ও নাটক রচনার শুরু। হিন্দু পুরাণ ও বাংলার লোক সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ঘটে এ লেটো দলেই। নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে প্রবেশ করেন কলকাতায় বিশের দশকের শুরুতে। অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লব -এসব ইংরেজ সরকার বিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে নজরুল নিয়মিত গান রচনা শুরু করেন । ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে তিনি গজল রচনা শুরু করেন এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় একটানা বহু উৎকৃষ্ট গজল গান রচনা করেন। নজরুলের গজলের বিষয়বস্ত্ত প্রেম ও প্রকৃতি ।
১৯৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নজরুল নতুন এক ধারার সঙ্গীত রচনায় মনোনিবেশ করেন। এ সময়ে তিনি হিন্দু ভক্তিমূলক এবং ইসলামি গান রচনা শুরু করেন। নজরুল প্রায় এক হাজার ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করেন, যার মধ্যে হিন্দু ঐতিহ্যের শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন এবং ইসলামি ঐতিহ্যের হামদ্, নাত, নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ঈদ, মর্সিয়া প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের গান রয়েছে। এসব গানের রচনা ত্রিশের দশকের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল। । নজরুলের সঙ্গীত রচনার চতুর্থ ধারাকে আধুনিক ও লোক-ঐতিহ্যভিত্তিক সঙ্গীত সৃষ্টির পর্বরূপে চিহ্নিত করা যায়। এসব গানের মাধ্যমে নজরুল আধুনিক বাংলা গানের ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
নজরুলের সঙ্গীত-জীবনের পঞ্চম ও শেষ পর্যায় হচ্ছে রাগভিত্তিক গান সৃষ্টির পর্ব; এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এ ক্ষেত্রে তিনি রাগভিত্তিক গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নব নব সৃষ্টিতে মৌলিক সঙ্গীত-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর মিশ্রণে নতুন রাগ-রাগিণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে সঙ্গীতশাস্ত্র সম্পর্কে নজরুলের ছিল সূক্ষ্ম জ্ঞান ও রসবোধ। তিনি ‘বেণুকা’ ও ‘দোলনচাঁপা’ নামে দুটি রাগিণী সৃষ্টি করেন। হিন্দি ভাষা ছাড়া খেয়াল, ধ্রুপদ-এসব উচ্চাঙ্গসঙ্গীত রচিত হতে পারে না এ ধারণা নজরুল মিথ্যা প্রমাণিত করেন বাংলায় বিভিন্ন রাগ-রাগিণীভিত্তিক গান রচনা করে। নজরুল অনেক গান নিজের কণ্ঠেও রেকর্ড করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন রাগ-রাগিণী ও সুর-তালের ব্যবহার করে আধুনিক বাংলা গানকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই, হাজার বছরের বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। সংগীত জগতে নজরুল অনণ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গান সম্পর্কে নজরুলের সুস্পষ্ট মন্তব্যই তার প্রমাণ, “আপনারা আমার কবিতা সম্পর্কে যা ইচ্ছা হয় বলুন, কিন্তু গান সম্পর্কে নয়। গান আমার আত্মার উপলব্ধি।”
-সংকলন: জান্নাতুল ফেরদৌস, সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার।