শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

আজ ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আজকের এই দিনে আমরা গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যাঁদের আমরা হারিয়েছি স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি অধ্যাপক জি সি দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামউদ্দীন আহমেদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাহিত্যিক সেলিনা পারভীনসহ সকল শহীদ সন্তানকে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞের সূচনা করেছিল, একেবারে শেষ দিকে এসে পরাজয়ের আগ মুহূর্তে তা রূপ নেয় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তখন তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় বেছে বেছে হত্যা করেছিল জাতির অগ্রণী শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের। এসব হত্যার কারণটি স্পষ্ট, পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা চেয়েছিল স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া দেশটিকে মেধায়-মননে পঙ্গু করে দিতে।
বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পিত ঘটনার সঙ্গে এ দেশেরই কিছু মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তি রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতার কারণেই এতটা ব্যাপক ও পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এই বাহিনীগুলোর সদস্যরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের উঠিয়ে এনেছে এবং তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই সম্পন্ন করেছে হত্যাযজ্ঞ।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শহিদদের নিকট আত্মীয়রা মিরপুর এবং রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে স্বজনের মৃতদেহ সনাক্ত করেন। অনেকের দেহে আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। হত্যার পূর্বে তাদের যে নির্যাতন করা হয়েছিল সে তথ্যও তখন বের হয়ে আসে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা অনুযায়ী, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে ঘৃণ্যতম অপরাধ। এসব হত্যাযজ্ঞে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলো, তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি। দীর্ঘদিন পর হলেও একাত্তরে যাঁরা হত্যাযজ্ঞ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিলো, তাঁদের বিচার-প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলেছে। আর এই বিচারের মাধ্যমেই জাতি দায়মুক্ত হতে পারে। এই বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীরা শিক্ষা পেতে পারে যে, দেশ এবং জাতির বিরুদ্ধাচরণ করলে এক দিন না এক দিন তার সাজা ভোগ করতে হয়।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে আজ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে আজকের তরুন সমাজ। আমরা আমাদের প্রতিদিনের কাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে পারলেই দেশ এগিয়ে যাবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য অর্জিত হবে এবং সেই সাথে শহীদদের আত্মা পাবে শান্তি।
গ্রন্থনা: তারিক মুহাম্মদ, উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার।