বাংলা নববর্ষ ১৪২৮
আজ ১লা বৈশাখ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। বাংলা পুঞ্জিকা বছরের প্রথম দিন। শুভ নববর্ষ !
নববর্ষ পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিসত্ত্বার ঐতিহ্যের একটি অনিবার্য অংশ। বাঙালির ঐতিহ্যকে যে সকল উৎসব ধারণ করে আছে সেগুলোর অন্যতম বাংলা নববর্ষ। সুপ্রাচীন কাল থেকে বাঙালিরা বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ১লা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলা নববর্ষ বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার-আচরণ, অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্ববৃহৎ সার্বজনীন উৎসব।

মুঘল সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণের পরপরই একটি বৈজ্ঞানিক, কর্মপোযোগী ও গ্রহণযোগ্য বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যেখানে দিন ও মাসের হিসাবটা যথাযথ থাকবে। বিখ্যাত পণ্ডিত ও সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, হিজরি বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না। কারণ চন্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে অন্যদিকে সৌর বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। ফলে দুটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে ব্যবধান থেকে যায় বছরে ১১ বা ১২ দিন। এভাবে মূলত সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে জন্ম ঘটে বাংলা সনের ।
বাঙালিরা এ দিনে পুরনো বছরের ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে মহা আনন্দে বরণ করে নেয়। মূলত, মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এরপর পরবর্তী দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। পয়লা বৈশাখের এই উৎসবটি কালক্রমে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। একটা সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হতো। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
বাংলাদেশে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হওয়া কমিটি পুরনো বাংলা দিনপঞ্জিকে সংশোধিত করেন। এখানে প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন, আর বাকি মাসগুলোকে ৩০ দিন করা হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন ধার্য করা হয়। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। এরপর থেকে, জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনাও প্রতি বছর নববর্ষ ১৪ এপ্রিল হয়ে থাকে। ১৪২৬ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয়বারের মত বাংলা পুঞ্জিকায় সংশোধনী আনা হয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিশেষ দিনগুলোর সমন্বয় আনতে বাংলা একাডেমি এই পরিবর্তন আনে। নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই ছয় মাস ৩১ দিনে হবে। ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল অধিবর্ষের বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হবে।
বাংলা নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বাংলার গ্রাম আর শহরের জনগোষ্টি এ উৎসবে মেতে উঠে একই সাথে। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে অনেকেই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। অবশ্য এ বছর আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসজনিত সংক্রমন প্রতিরোধ এবং দেশের মানুষকে এই ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য উন্মুক্ত স্থানে জনস্বার্থে সকল জনসমাগম বন্ধ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও পৃথিবীর আরো অনেক দেশে পয়লা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনে নিয়ে আসুক সুখ আর শান্তি; একই সাথে এমন সুন্দর দিনে প্রত্যাশা করি, করোনা মুক্ত হোক সারা বিশ্ব । এগিয়ে যাক বাংলাদেশ, এগিয়ে যাক বাংলাদেশের মানুষ । শুভ নববর্ষ ১৪২৮।
গ্রন্থনা: তারিক মুহাম্মদ, উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার। ১৪ই এপ্রিল ২০২০ খ্রিস্টাব্দ/ ১লা বৈশাখ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ।