আজ জাতীয় শোক দিবস

আজ রবিবার শোকাবহ ১৫ই আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতির শোকের দিন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে ভোরের আলো ফোটার আগেই বাঙালি জাতিকে মুক্তির আলো দেখানো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল পাকিস্তানপন্থী বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য। জাতির পিতাকে হত্যা করে ঘাতকেরা জাতির ললাটে এঁকে দেয় পিতৃ হন্তারকের কালিমা। গভীর আবেগ ও বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি আজ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করছে।
‘সেই রাতে আকাশে একটিও নক্ষত্র ছিল না, সেই প্রাতে সূর্যালোক বন্দি ছিল কৃষ্ণ গহ্বরে, সেই রাতে ঈশ্বর তাই দেখতে পাননি, পৃথিবীতে কী ঘটেছিল!’ সেই রাতে আকাশে কালো মেঘ ছিল, ছিল না বৃষ্টি, ছিল না আঁধার বিদীর্ণ করা নীল জোছনা। শ্রাবণের আঁধারে ডুব দিয়েছিল বৃষ্টিহীন রুক্ষ রাত। আর এই অমানিশার অন্ধকারে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। রাজধানীর আকাশে-বাতাসে তখনো ছড়ায়নি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে আজানের সুরেলা ধ্বনি। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘোর কৃষ্ণ প্রহরে হায়েনার দল বেরিয়ে আসে।
১৫ই আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বেরিয়ে আসে বর্বরোচিত ঘটনার নৃশংস চিত্র। শিশু পুত্র রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা ঘুমাচ্ছিলেন দোতলায়। শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামাল তিন তলায়, শেখ জামাল ও রোজী জামাল এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ঘুমিয়েছিলেন দোতলায়। ঘুমাচ্ছিল বাংলাদেশ। শুধু জেগেছিল চক্রান্তকারীরা। ঘাতক এজিদ, সীমার আর দুর্যোধনের অট্টহাসিতে বিদীর্ণ হয় রাত্রির নিস্তব্ধতা। পৈশাচিক উল্লাসে আবারো খণ্ড-বিখণ্ডিত হয় রক্তে কেনা বাংলাদেশ। ভোরের আগেই অন্ধকারের কালো মেঘে ঢেকে যায় বাংলার আকাশ।
অপারেশন ১৫ই আগস্টের নেতৃত্বে ছিল কর্নেল ফারুক। তারই পরিকল্পনায় প্রায় ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় ৩টি দল সাজানো হয়। ৩টি দলের প্রধান টার্গেট শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাড়ি। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম ঘটনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মহিউদ্দিনকে। তাদের সঙ্গে ছিল এক কোম্পানি ল্যান্সার। সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্ব নেয় ডালিম। আর খুনি ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে দেয়া হয় শেখ মণির বাড়ি আক্রমণের। খুনিদের ওপর নির্দেশ ছিল সবাইকে হত্যা করার।
এছাড়া খুনিদের বাধাদানকারী বা পরে বিপদের কারণ হতে পারে এমন যে কাউকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কর্নেল ফারুক। হত্যাকাণ্ডে বাধা আসতে পারে এমন স্থানেও কিছু সৈন্য মোতায়েন ও ট্যাঙ্ক প্রস্তুত করে রাখে হায়েনারা। ভোর ৪টা ০৮ মিনিটে রক্তপিপাসু ঘাতক চক্র ৩ দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাঙ্ক অবস্থান নেয়। ভোর ৫টার মধ্যেই ঘেরাও করে ফেলে ৩২ নম্বর বাড়ি এবং আশপাশের এলাকা।
আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে শত্রুরা বঙ্গবন্ধু ভবনে আক্রমণ করে। গোলাগুলির মধ্যে বিভিন্ন দিকে ফোন করে সাহায্য চান বঙ্গবন্ধু। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কেউ ফোন ধরছিল না। মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে গিয়ে সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর কাছে সহায়তা চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার আই এম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস।’ সেদিন ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয়। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ কিন্তু ঘাতকের হাত তাতে কাঁপেনি। ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিটে বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়েন।

১৫ই আগস্টের এই শোকবহ দিনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, নবপরিণীতা ২ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। প্রবাসে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর ২ মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ওই রাতে আরো প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কমকর্তা ও কর্মচারী।
১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ই নভেম্বর। নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। এই হত্যাকান্ডে আরও পাঁচজন আসামি এখনো পলাতক আছেন।
করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর শোক দিবসের কর্মসূচি যতটা সম্ভব সীমিত পরিসরে পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। এ ছাড়া জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীগুলো ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।
শোকের এই দিনে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা সহ পরিবারের শহীদ সকল সদস্যদের প্রতি জানাই আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।