বঙ্গবন্ধু ও আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা

ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনসহ নানা ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসে একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের আহ্বানে জেগে ওঠে নিরীহ বাঙালি। যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। এরপর ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তাতে বলা হয়, “ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও ।”
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়৷ এছাড়া সকাল থেকে মাইকিং করা হয়- “ঢাকায় আকস্মিকভাবে পাকিস্তানী সেনারা নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ করেছে এবং খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।”
তৎকালীন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেতারের চট্টগ্রামের কয়েকজন কর্মী এ সময় একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। তারা কালুরঘাটে অবস্থিত বেতারের ছোট্ট একটি কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি পাঠের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি সর্বপ্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। পরে একাধিক কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি পাঠ করা হয়।
২৬শে মার্চেই যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তার প্রমাণ মেলে পরের দিনের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে। ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি, শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার খবর ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়। বিবিসির খবরে তখন বলা হয়, “পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।”
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, “ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।” দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর খবর ছিল, “বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।” লন্ডন ভিত্তিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়। ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক খবরে বলা হয়, “একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।”নিউইয়র্ক টাইমস-এ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। পাশেই লেখা হয়, “স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।” এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বীর বাঙালি মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রশিক্ষণহীন নিরস্ত্র বাঙালিরা যেভাবে একটি সুশৃঙ্খল অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে তেমন সংগ্রামের দৃষ্টান্ত বিরল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।
———-
গ্রন্থনা: মোঃ জাহিদুর রহমান, ট্রাফিক সম্প্রচার কার্যক্রম, বাংলাদেশ বেতার।