একজন মহীয়সী নারীর কথা

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ফজরের আজানের মধুর ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে চার দিকে। সুবহে সাদিকের পবিত্র সময়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে এসেছিল সেনা-ট্যাঙ্ক। বুট জুতার ভারি আওয়াজসমেত মারণঘাতী অস্ত্র নিয়ে যে বাড়িতে ঢুকে পড়ে কয়েকজন বিপথগামী সেনাসদস্য, সে বাড়ি রেনুর বাড়ি। বাংলার গৃহবধূ স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখি গৃহকোণ গড়ে তোলে। রেনুও গড়েছিলেন। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বাড়িটা রেনু মানে বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নিজের হাতে বানানো ছিল। প্রথমে এক তলা। এরপর দুই, এরপর তিন তলা। রেনুর সকল সাধ, সকল আশা সংসার ছাপিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাধ আর আশা হয়ে মিশে যায় এই বাড়িতে। সেই আশার আলোয় আঁধার নেমে আসে ১৯৭৫ খ্রিস্টব্দের ১৫ই আগস্টের ভোরে। আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু আর রেনুর প্রথম পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল। ঘুম ভেঙ্গে উঠে আসা শেখ মুজিব, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেন, সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠে এসেছে বেঈমান খুনীরা। খুনিদের উদ্দেশ্যে গর্জে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠতেই খুনীর হাতের অস্ত্র ঝাঁঝরা করে ফেলে বাংলাদেশের বুক। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েন আমাদের তেজোদীপ্ত রাজনীতির কবি। মৃত্যু যন্ত্রণা এক ফোঁটা আর্তনাদেরও করুণ রূপ নিতে পারেনি। সারা জীবন সম্মানের সাথে মানুষের জন্য লড়াই করা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, প্রিয় নেতার পবিত্র আত্মা মিশে যায় বাংলার বাতাসে। মুখ উঁচু করে রাখা তাঁর দীর্ঘ শরীরের সকল সৌন্দর্য স্থির হয়ে যায় মাতৃভ‚মির দুর্দশাকে জাগিয়ে দিয়ে। আর ঠিক সেই সময় দোতলায় দাঁড়ানো খুনীরা ঘিরে ধরে রেনুকে। রেনুর তীব্র গর্জন ছিল এরকম- আমি কোথাও যাব না। উনাকে যখন মেরে ফেলেছ, আমাকেও মেরে ফেলো।
রেনু কোথাও যাননি। যেতে পারেন না। প্রিয়তম স্বামী, খেলার সাথি মুজিবের পাশে থাকার সাধ আর আশা যার আজীবনের, জীবনের সাধ্য কি তাকে মুজিবের থেকে আলাদা করে! গুলির মুহূমুর্হু আওয়াজে লুটিয়ে পড়া রেনুর কোমল সুন্দর পবিত্র শরীর জড়িয়ে রাখা শাড়ি রক্তাক্ত হয়, চুড়িসহ হাত মাটিতে পড়ে আরেকবার জানিয়ে দেয়, বাংলার বধূ, বাংলার মা এমনি হন। কেবলমাত্র স্বামী-সন্তানকে নিয়ে হাসি আনন্দে ভরপুর সংসার পাওয়ার সাধ আর আশা নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বাংলাদেশের সমৃদ্ধির সাধ আর আশা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা হিসেবে গড়ে তোলার নেপথ্য কারিগর হিসেবে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেলেন, তার খোঁজ হাজার বছরেও মিলবে কি?
রেনু থেকে বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে হয়ে উঠলেন বাংলার মা, বঙ্গমাতা। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট তারিখে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। বাবা শেখ জহুরুল হক ও মা হোসনেয়ারা বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে ছোট রেনু। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন, পাঁচ বছর বয়সে মা’কে, সাত বছর বয়সে হারান দাদাকে। একমাত্র পুত্র হারিয়ে দাদা শেখ আবুল কাশেম সব সম্পত্তি দুই বোনকে লিখে দিলেন, দুই বোনের বিয়ে দিলেন আত্মীয়ের ভিতর। রেনুর বিয়ে হ’ল খোকার সাথে। খোকা শেখ লুৎফর রহমান আর সায়েরা খাতুনের বড় ছেলে। ভালো নাম শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশব থেকেই মানুষের বিপদে-আপদে ছুটে যাওয়া খোকা সবার কাছে মুজিব, সকলের মুজিব। স্কুল জীবনেই প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যাওয়ার পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে শুরু করেছিলেন বৃটিশ খেদাও আন্দোলন, চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। দিন-রাত মানুষের জন্য কাজ করছেন, বৃটিশদের কূটকৌশলে সৃষ্ট হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বাড়ি যাওয়ার ফুরসত মেলে না। ওদিকে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে রেনু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, একটি ছেলে হয়েছিল, বাঁচেনি। এরপরও স্বামীকে লেখা চিঠিতে রেনুর ভাষ্য ছিল এরকম- “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্তমনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহ্র উপর আমার ভার ছেড়ে দিন।”
তরুণ মুজিব সৃষ্টিকর্তার কতটা আশীর্বাদ পেয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর রেনু। কিন্তু বৃটিশ হটিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া বাঙালিদের কপালে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ হয়ে আসেনি পাকিস্তান নামের নতুন দেশ, যে দেশে কিছুতেই কমলো না রেনুর স্বামী মুজিবের কষ্ট। পাকিস্তান সরকারের রুদ্ররোষে মুজিবকে বারবার কারাগারে যেতে হয় এবং তিনি কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়েন। রেণু একলা একা সংসার সামলান। সন্তানদের জন্মের সময়ও স্বামীকে কাছে পান না। বারবার লন্ডভন্ড হয় রেনুর সাজানো সংসার। বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না কেউ। ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করতেও কী যে কষ্ট!
দুরদর্শী রেনু তখনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজের একটি বাড়ি বানাবেন ঢাকাতে। খুব চেষ্টা করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে বাড়ির কাজ শুরু করলেন। সব কিছু একা হাতে সামলান রেনু। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, গৃহশিক্ষক রাখা, বাজার-সদাই, রান্নাটাও নিজ হাতে করেন। গ্রামের কার কী সাহায্য করতে হবে, দলের কোন্ নেতার কী সমস্যা, সব তিনি দেখছেন, ক্লান্তিহীন। এর মধ্যে গান শুনছেন, বই পড়ছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া দেখছেন, কামাল সেতার শিখছে, হাসিনা ছবি আঁকছে, রেহানা নাচ শিখছে। ফাঁকি দেওয়ার জো নেই। ড. নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর লেখা বই ‘বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব’-এ তাঁর সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, রেনু তাঁকে বলেছেন, “আপা, আমি চুবানী খাইয়া খাইয়া সাঁতার শিখছি। বাচ্চাদের এতটুকু বিলাসিতা শিখাই নাই।” আপাদমস্তক গৃহবধূ, মা এই রেনুই আবার জেলখানায় দেখা করতে গিয়ে স্বামীকে বলেছেন, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।”
বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্য আমরা পেয়েছি লেখক শেখ মুজিবুর রহমানকে। পেয়েছি নির্ভীক রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুকে। জেলের বাইরের সব খবর জানাতেন স্বামীকে। দলের জন্য নেতা যে নির্দেশনা দিতেন, তা শুনে আসতেন। সংসারের কোনো কিছু নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ভাবতে হয়নি। তেমনিভাবে রাজনীতির নানা কঠিন সময়েও সত্যিকারের কমরেডের মতো সঠিক পরামর্শ পেয়েছেন স্ত্রীর কাছ থেকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নেওয়ার বিষয়ে নেতাদের সমর্থনকে হটিয়ে দিয়ে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে এর বিরোধীতা করেছেন। জনরোষ সামলাতে না পেরে ছয় দফার দাবীতে অটল থাকা বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার, আর তখনি আসলে নির্ধারিত হয়ে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্ভাবনা। কেননা, এর ধারাবাহিকতায় সত্তরের নির্বাচন, ছয় দফার সমর্থনে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ এবং পাকিস্তানের শাসকদের ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা উন্মাতাল করে তোলে বাঙালির স্বাধীনতার দাবীকে। একাত্তরের ৭ই মার্চ তারিখে ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন, এ নিয়ে হাজারো চাপ, নানা জল্পনা-কল্পনার মুখে অটল থাকার কথা জানিয়ে বঙ্গমাতা বলেছিলেন, কারো কথা শুনতে হবে না, বঙ্গবন্ধু যেন বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথাগুলোই স্পষ্ট করে বলেন। বঙ্গবন্ধু ঠিক তা-ই করেছিলেন। ভাষণের সময় সামনের টেবিলের ওপর ছিল না কোনো কাগজ। চোখের কালো ফ্রেমের চশমাটা টেবিলের ওপর রেখে বঙ্গবন্ধু উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের কথামালা। সেই স্বপ্নই অবশেষে ধরা দিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সবাইকে নিয়ে বন্দী রেনুকে ছাড়তে হয়েছিল নিজের বাড়ি। স্বাধীন দেশে তিনি ফিরে পেলেন প্রিয়তম স্বামীকে, প্রিয় গৃহকোণকে। বড় সাধ, স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করবেন। বড় আশা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে স্বামীর পাশে থাকবেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগী, লাঞ্ছিত মা-বোনকে সহযোগিতা করতে, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ সব রকমভাবে তাদের পাশে দাঁড়ালেন রেনু। সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার নানা উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু সব যে থেমে গেল।
বঙ্গবন্ধুর বড় প্রিয় ছিল এই গান- “সাধ না মিটিল, আশা না পুরি”’। সোনার বাংলাদেশ গড়ার সাধ পূরণ হয়নি বঙ্গবন্ধুর। সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল রেণুরও। তবুও পরাজয় মেনে নেননি তাঁরা। তাঁদের আত্মত্যাগের বদৌলতে খাদে পড়ে যাওয়া বাংলাদেশ তাঁদেরই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে নিতে পেরেছে। আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ আত্মসম্মান নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, নিতে পারে।
টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সাধারণ এক নারী রেণু বাংলা ও বাঙালির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কাজে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করে হয়ে ওঠেন বঙ্গমাতা।্ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে শহিদ বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছার অবদান বাংলাদেশ কখনো ভুলবে না। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি জানাই হাজারো কৃতজ্ঞতা, সশ্রদ্ধ সালাম।
———–
লেখক: নাসরীন মুস্তাফা, নাট্য ব্যক্তিত্ব।